ইসলাম ও মুসলমানদের উন্নতি দেখে প্রতি হিংসায় প্রজ্জ্বলিত কাদেবর। মহানবী (সঃ)-এর শ্রদ্ধের চাচা আবু তালিব কাছে গিয়ে প্রস্তাব পেশ করল যে, আপনি আমাদের সরদার। আপনার সাথে আমরা অসদাচারণ করতে চাই না। কিন্তু আপনি যদি আপনার ভাতীজাকে আমাদের হাতে উঠিয়ে না দেন তবে আমরা সকলেই একেযোগে আপনার পরিবার ও আপনাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করব এবং আপনাদের সাথে আমাদের ওঠা-বসা, চলা-ফেরা, বেচা-কেনা সবকিছুই বন্ধ করে দিব। অতএব, আপনি আপনার ভাতীজাকে এ নতুন ধর্ম প্রচার হতে বিরত রাখুন। অন্যথায় আমাদের হাতে তুলে দিন। নতুবা আপনাদের সাথে চূড়ান্ত অবরোধ করব।
আবু তালিব এ প্রস্তাব শুনে খুবই চিন্তিত হলেন। কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, "মরতে হয় সরব তবুও আমাদের মান-ইজ্জত নষ্ট করে আমার ভাতীজাকে ওদের হাতে তুলে দিব না।" তাই তিনি তাদেরকে সাফ জবাব দিয়ে ফেললেন, তোমাদের যা করার করতে পার কিন্তু আমি এক মুহূর্তের জন্য আমার ভাতীজাকে তোমাদের হাতে সমর্পণ করব না এবং তাঁকে তাঁর কাজ করতে বাধাও প্রদান করব না।
খাজা আবু তালিবের এ কথা শুনে কাফেররা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। তারা বনী হাশিম ও বনী আব্দুল মুত্তালিবের সকলের সাথে সকল প্রকার সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করে ফেলল। আর এক অঙ্গিকার নামা লিখে কা'বার দ্বারে টানিয়ে দেয়া হল। এ অঙ্গিকার নামার লেখক ছিল মানস বিন আরকাম। আল্লাহ্ তায়ালা তার হাতকে অবশ করে দিয়েছিলেন।
এক পাহাড়ের উপত্যকায় হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ও তার সকল বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, কাফির-মুসলিম ভেদাভেদ ব্যতিরেকে সকলকেই অবরুদ্ধ করা হল। তিন বছর পর্যন্ত বহু দুঃখ কষ্টে দিনাপিাত করার পর নবী করীম (সঃ)-এর মু'জেজা ও কতিপয় লোকের অঙ্গিকার ভঙ্গের ফলে এ অবরোধ তুলে নেয়া হল।
মহানবী (সঃ)-এর চিন্তার বৎসর:
হাজার নির্যাতন ভোগের পরও নবী করীম (স) দ্বীনের অমিয় সুধায় জনগণকে সায়লাব করেই চলতে লাগলেন। নবুওয়াতের দশম বৎসর খাজা আবু তালিব বিরামহীনভাবে হুজুর (সঃ)-এর সাহায্য সহযোগীতা নিজেকে ব্যাপৃত রাখলেন। কিন্তু নবুওয়াতের দশম বর্ষে রাসূল (সঃ)-এর সম্মনিত চাচার তিরোধান হয়। আর এ বিরহ-বেদনা শেষ হওয়ার আগে আগেই মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে সহধর্মিনী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)ও ইহধাম ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমালেন। এতে নবী করীম (সঃ) হত বিরল ও বিমূর্ণ হয়ে পড়লেন। আর এ কারণেই নবী করীম (সঃ) এ বছরকে 'আমূল হুম্ন' বলে আখ্যায়িত করলেন। যার অর্থ হল চিন্তার বছর।
প্রিয় নবী (সঃ)-এর তায়েফ গমন:
হিজরীর দশম বছর। খাজা আবু তালিবের ইন্তেকাল হয়ে গেল। রাসূল (সঃ)-কে কষ্ট দেয়া থেকে আর কে রুখতে পারে কাফেরদের। সকলেই নবী করীম (সঃ)-কে নানাভাবে কষ্ট দিতে আরম্ভ করল। রাসূল (সঃ) তায়েফে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করলেন এবং হযরত যায়েদ বিন হারেছা (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে একসময় পাড়ি জমালেন সবুজ-শ্যামল, সুজলা-সুফলা, তায়েফ ভূমিতে। তাদের দাওয়াত দিলেন একত্ববাদের তাওহীদের। আর বললেন, তোমরা বল-না ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তবেই তোমরা মুক্তি পেয়ে যাবে।
বর্বর তাফেফবাসী রাসূল (সঃ)-এর মায়াবী আহ্বানে তো সাড়া দিলই না, বরং তাঁকে নির্যাতন করার জন্য উঠে পড়ে লাগল তারা। তারা প্রস্তরাঘাতে রাসূল (সঃ)-এর সমস্ত দেহ মোবারককে জর্জরিত করে ফেলল। পবিত্র বদন ফেটে ফুয়ারার ন্যায় রক্তের ঝর্ণা প্রবাহিত হল। তবুও নবী করীম (সঃ) তাদের জন্য সামান্য একটু বদদোয়া ও করলেন না।
মহানবী (সঃ)-এর বিশেষ পুরষ্কার:
নবুওয়াতের দশম বর্ষ। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত রাসূল (স)-এর সহধর্মিনীর ওফাত। চাচা আবু তালিবের তিরোধান। তায়েফবাসীদের নির্যাতন। মক্কার কাফিরদের উৎপীড়ন। সব মিলিয়ে রাসূল কষ্ট ও হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে সান্ত্বনা দিতে চাইলেন। তাকে বিশেষ পুরষ্কারে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। তাঁকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করতে চাইলেন জিব্রাঈল আমীন (আঃ)-কে পাঠিয়ে দিলেন, মহানবী (সঃ) আকাশে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
নবুওয়াতের দশম বর্ষের রজব মাসের সাতাইশ তারিখ। নবী করীম। (সঃ) হাতিমে কাবায় শায়িত। জিব্রাঈল আমীন (আঃ) এসে উপস্থিত। বললেন, হে রাসুল। আপনি উঠুন। চলুন আমার সাথে। আপনার বন্ধু আপনাকে আহ্বান করেছে। আপনার প্রতীক্ষায় তিনি অপেক্ষা করছেন। রাসুল (স) ওজু করে জিব্রাঈল আমীন (আঃ)-এর সাথে বোরাকে চড়ে বসলেন। ক্ষণিকের মধ্যেই পৌঁছে গেলেন বায়তুল মাকদিসে মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মাকদিসে মোযেজা স্বরূপ সকল আম্বিয়ায়ে কেরামকে জমায়েত করা হল। জিব্রাঈল আমীন (আঃ) আযান ফুকালেন। সকলেই নামাজ আদায়ের জন্য কাতারবন্দি হলেন। জিব্রাঈল আমীন (আঃ) রাসুল (স)-এর হাত ধরে সামনে বাড়িয়ে দিলেন। তিনি ইমামতি করলেন সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের। দু'রাকাত নফল নামায আদায় করে উর্দ্ধগমন করলেন।
প্রখম আকাশে পৌঁছে হযরত জিব্রীল (আঃ) আকাশের দরজার লক করলেন। পেট প্রহরীরা জিজ্ঞাসিল, কোন সত্তার আগমন ঘটল। জিব্রীল। (আঃ) বললেন, তোমরা যার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছ! সে যুহাস্কাসুর রাসুলুল্লাহ্ (সঃ)-এর মুবারক আগমন।
চাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদ (সঃ)। প্রথম আকাশে দিছিলে মিছিলে যুখরিত করে সকলেই নবী করীম (সঃ)-এর পেছনে চলতে লাগল। এভাবেই একে একে সপ্তাকাশ পর্যন্ত আরোহণ করলেন। পথিমধ্যে প্রথম আকাশে হয়রত আদম (আ), দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈসা ও ইয়াহ্ ইভাইয়া (আ), তৃতীয় আকাশে হযরত ইউসুফ (আঃ), চতুর্থ আকাশে হরেত ইদ্রীস (আঃ), পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (আঃ), যষ্ঠ আকাশে হয়রত মুসা (আঃ) ও সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়, এবং নবী করীম (সঃ) সকলকেই সালাম বিনিময় করেন ও তাদের সাথে কথা-বার্তা বলেন।
এরপর নবী করীম (সঃ) সিদ্রাতুল মুনতাহার দিকে অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে দৃষ্টিগোচর হল হাউজে কাউসার ও বেহেশত। এরপর তাঁকে দেখান হল দোযখ। যাতে হচ্ছিল ভীষণ আযাব। দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুন। তিনি তথায় দেখতে পেলেন একদল লোক। যারা মানুষের গোশত ভক্ষণ করছিল। রাসুল (সঃ)-এর কারণ জিজ্ঞাসিলেন। জিব্রাইল (আঃ) বললেন, এরা মানুষের গীবত করে বেড়াত। তাই তারা মরা মানুষের গোশত ভক্ষণ করছে। প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন গীবত কত বড় জঘন্য অপরাধ। আর বর্তমান যুগে আমরা গীবতকে কোনরূপ দোষই মনে করি না। গীবত বলা হয়- কার এমন দোষ তার অনুপস্থিতিতে অন্যের কাছে বর্ণনা করা যা তার মধ্যে রয়েছে। আসুন আজ হতেই আমরা গীবতকে ছেড়ে দেই, এবং দোযখের ভয়াবহ শাস্তি হতে নিজেকে রক্ষা করি।
এরপর নবীয়ে করীম (সঃ) সিদরাতুল মুনহার দিকে অগ্রসর হন, এবং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সাথে সরাসরি কথোপকথন শেষে আবার পৃথিবীর মুকে চুলে আসেন। আর এ ঘটনা দুনিয়ার হিসেবে এক রাতেই সংঘটিত হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সময় অনেক লেগেছিল। কিন্তু নবী করীম (সঃ)-এর এ সফর যখন শুরু হয়েছিল। তখন নব মণ্ডল ভূ-মণ্ডলের সকল বস্তু স্বীয় কাজ কর্ম ছেড়ে তার সম্মানার্থে আপন গতি-বিধিকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাইতো মহানবী (সঃ) পুনরায় হাতীমে ফিরে এসে দেখলেন যে, অজুর পানি গড়িয়ে পড়ছে। যদিও এটা বাস্তবে অসম্ভব। কিন্তু আল্লাহর কিছে সম্ভব।
মদীনায় হিজরত:
নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বৎসর। পরপর দু'বছর হজ্জ মওসুমে মদীনার লোকজন মককায় এসে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিল। তারা মহানবী (সঃ)-কে তাদের ভূমিতে আশ্রয় নেয়ার আমন্ত্রণ জানাল। মহানবী (সঃ) তাদেরকে সম্মতি দিয়ে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় রইলেন। ইতিমধ্যে একরাতে মক্কার প্রতিটি সম্প্রদায় থেকে এক একজন করে যুবক রাসূল (সঃ)-কে হত্যা করার জন্য একত্রিত হয়ে মহানবীর (স)-এর বাড়ি ঘেরাও করল। এদিকে আল্লাহ্ তায়ালা রাসূল (সঃ)-কে হিজরতের নির্দেশ দিলেন। হজুর (সঃ) সুরায়ে ইয়াসীন তেলাওয়াত করলেন।
ফলে আমি তাদের চোখে আবরণ ঢেলে দিলাম ফলে তারা দেখতে পেল না।
নবী করীম (সঃ) স্বীয় পালঙ্কে হযরত আলী (রাঃ)-কে শুইয়ে দিয়ে, তার কাছে গচ্ছিত সকল আমানত তাকে বুঝিয়ে দিয়ে, তিনি দ্বার খুলে শত্রুদের মাঝখান দিয়ে পৌঁছে গেলেন সিদ্দীকে আকবর হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর গৃহে। তাঁর দু'জনে চললেন মদীনার দিকে।
পাবলিশার অর্গানাইজেশন সিয়াম হাসান নিউজ লিমিটেড