নবুওয়াত প্রাপ্তি:
রাসূল (সঃ)-এর আদতে মুবারাকাহ ছিল যে, তিনি হেরা গুহায় গিয়ে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। এ হেরা গুহাতে তিনি একাধারে অনেকদিন কাটিয়ে দিতেন। হুজুর (সঃ)-এর বয়স যখন চল্লিশ বছর একদিন হল, তখন ঐশীদূত হযরত জিব্রাঈল আমীন এসে বলল, (ইয়া মুহাম্মদ ইব্রা) হে, মুহাম্মদ তুমি পড়। প্রতি উত্তরে মহানবী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, (মা আনা বিকারিন) আমিতো পড়তে জানি না। তখন হযরত জিব্রাঈল (আঃ) তাঁকে পরপর তিন বার বুকের সাথে মিলিয়ে চাপ দিলেন। এরপর মহানবী (স) পড়তে লাগলেন।
উচ্চারণ:
ইন্দ্বরা বিন্নি রাকিংকাল্লাজী খালা, খালাকাল ইনসানা মিল আলাজ্ব। ইরাহ ওয়া রাববুকাল আকরামুল্লাজী আল্লামাবিল জ্বালাম। আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়া'লাম।
অর্থঃ
পড় তুমি সৃষ্টিকর্তা প্রতিপালকের নামে। যিনি মানুষকে জমাট রক্ত হতে সৃষ্টি করেছেন। পড় তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে এমন জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতো না।
এরপর নবী করীম (সঃ) বাড়িতে চলে আসলেন এবং হযরত খাদীজা (রাঃ)-কে বললেন আমায় কম্বল মুড়ি দিয়ে নাও। হযরত খাদীজা (রাঃ) দেখলেন মহানবী (সঃ)-এর শরীরে উষ্ণতা অত্যাধিক বেড়ে গেছে। তিনি তার সেবা সুশ্রুষা করতে ব্যাপৃত হলেন। রাসূল (সঃ) ধীরে দীরে হেরা গুহার বিস্তারিত বিবরণ খুলে বললেন।
ওয়ারাকা বিন নওফলের দরবারে হযরত খাদীজা (রাঃ):
ওয়ারাকা বিন নওফল ছিলেন হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর চাচাতো ভাই। তিনি ছিলেন একজন প্রিয়ীয় পণ্ডিত বা খ্রিস্টীয় ধর্ম যাজক। তিনি ইয়াহুদী হতে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। হযরত খাদীজা তার কাছে পিয়ে মহানবীর বিস্তারিত বিবরণ খুলে বললেন। সাথে সাথেই ওয়ারাকা খাদীজা-কে বললেন, এতে কোন ভয়ের কারণ নেই। তিনি সর্বশেষ নবী হবেন আমি ইঞ্জিলে তার বিস্তারিত তথ্য পেয়েছি। হযরত খাদীজা ফিরে গেলেন আপন গৃহে।
ইসলাম প্রচারের প্রথম ধাপ:
নবুয়াত প্রাপ্তির পর তিন বছর পর্যন্ত ইসলামের দাওয়াত গোপনভাবে চলতে থাকে। আর এ গোপন দাওয়াতের ফলেই ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), হযরত যায়েদ বিন হারিছ (রাঃ)। হযরত উসমান (রাঃ), হযরত আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা), হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা), হযরত যুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রাঃ), হযরত তালহা বিন উবাইদুল্লাহ (রাঃ), হযরত আবু উবায়দাহ্ ইবনুল জররাহ (রা), হযরত উবায়দা ইবনুল হারিস (রাঃ), হযরত সাঈদ বিন যায়দ আদভী (রাঃ), হযরত আবু সালমা মাখযুমী (রাঃ), হযরত খালিদ বিন যাঈদ বিন যায়দ আদতী (রাঃ), হযরত খালিদ বিন যাঈদ (রাঃ), হযরত উসমান বিন মাজউন (রাঃ), হযরত কুদামাহ বিন মাজউন (রাঃ), হযরত উবায়দুল্লাহ বিন মাজউন (রাঃ), হযরত আরকাম বিন আরকাম (রাঃ), হযরত সুহাইব রুমী (রাঃ), হযরত আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ), হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ), হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবীগণ।
প্রকাশ্য দ্বীনের দাওয়াত:
নবুওয়াতের তৃতীয় বর্ষের শেষলগ্নে আল্লাহ তায়ালা অবতীর্ণ করলেন-(ফাছদা' বিমা তু'মারওয়া আ'রিদ আনিল মুশরিকীন) অর্থ তুমি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দাও! যা তোমায় আদেশ করা হয়েছে। আর পরওয়া করনা মুশরিকদেরকে। এ আয়াতে নবীয়ে করীম (সঃ)-কে প্রকাশ্যে দ্বীন প্রচারের নির্দেশ প্রদান করা হয়।
নবী করীম (সঃ) মক্কার অদূরে সাফা পর্বতে আরোহণ করলেন। কুরাইশ সম্প্রদায়কে আহ্বান করলেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়। এ আওয়াজ মক্কার অলিতে-গলিতে পৌঁছামাত্রই সাফা পাহাড়ের পদতলে জায়ায়েত হল মক্কা নগরীর সকল মানুষ। মহানবী (সঃ) তাদের লক্ষ্য করে বললেন, ওহে, আমার স্বজাতি! যদি আমি বলি এ পাহাড়ের অপর প্রান্তে শত্রু বাহিনী তোমাদের উপর আক্রমণের অপেক্ষায় রয়েছে তবে তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে? উত্তরে সকলেই সমস্বরে বলে উঠল, অবশ্যই বিশ্বাস করব।
কেননা, আপনিতো আমাদের আল আমীন। আপনার কথা কিছুতেই মিথ্যা হতে পারে না। তখন নবী করীম (সঃ) বললেন, তবে শোন, আমি তোমাদেরকে এমন এক ভয়ানক অগ্নির ভয় দেখাচ্ছি, যা তোমাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিবে। তোমরা মৃত্যু কামনা করবে। কিন্তু তথায় আর কোন দিন মৃত্যু হবে না। কাজেই তোমরা সে আযাব থেকে পরিত্রান লাভ কর। তোমরা বল- লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। অর্থ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই আর মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর রাসূল। আর তোমরা ছেড়ে দাও তোমাদের মূর্তি অর্চনাকে। এরা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে না।
আর পারবেও না। এরাতো নিজেরাই নিজেদেরকে রক্ষা করতে অক্ষম। তবেই তোমরা সফলতা লাভ করতে পারবে। আর উভয় জগতে পরমানন্দে যিন্দিগী কাটাতে পারবে। মক্কার কুরাইশগণ শুনল না তার এ মায়াবী আহ্বান। তারা বুঝে শুনে তিরষ্কার করল মহানবী (সঃ)-কে। আবু লাহাব পাথর ছুঁড়ে মারল প্রিয় নবী (সঃ) দিকে। আর বলল, (আলি হাজা জামাতানা) এজন্য আমাদের জমায়েত করেছ? বন্ধুর শানে এমন বেয়াদবী আচরণ আল্লাহ্ বরদাশত করতে পারলেন না। চিরস্থায়ী ঠিকানা তার জাহান্নাম নির্ধারণ করে দিলেন। ফলে সে ঈমানের এ মহা দৌলত হতে বঞ্চিত হল।
সমস্ত আরবের বিরোধিতা ও হুজুর (সঃ)-এর দৃঢ়তা:
প্রকাশ্যে দ্বীনের দাওয়াতের কাজ চালাতে লাগলেন প্রিয় নবী (সঃ)।
কুরাইশদের মুর্খতা ও প্রতিমা পূজার অসারতা প্রকাশ হয়ে গেল। কুরাইশগণ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান মুহাম্মদ (সঃ) আবু তালিবের ভাতীজা, তাঁর সাথে অশালীন আচরণ করার দুঃসাহস নেই কার। কি করবে কুরাইশগণ। কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেল তারা। অবশেষে তারা খাজা আবু তালিবের কাছে এসে অভিযোগ দায়ের করল। তাঁর ভাতীজাকে নতুন ধর্ম প্রচার হতে বিরত রাখার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাল।
পরদিন আবু তালিব প্রিয় নবীকে (সঃ) একান্ত সঙ্গপনে, নিরালায় নিভৃতে নিয়ে কুরাইশদের হীন প্রস্তাব জানালেন। নবী করীম (সঃ) প্রতি উত্তরে বললেন, ওহে আমার প্রাণ প্রিয় চাচাজান! তারা যদি আমার এক হাতে চন্দ্র আর অপর হাতে সূর্য এনে দেয়। আর এর বিনিময়ে তারা আমার দ্বীন প্রচার করতে বারণ করে, তবুও আমি আমার এ দাওয়াত হতে বিরত হব না।
আবু তালিব যখন নবী করীম (সঃ) এ দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা জানতে পারলেন, তখন বললেন, ওহে আমার ভাতীজা! তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। আমি সর্বদা তোমার সহযোগীতায় ব্যাপৃত থাকব। আমার জীবদ্দশায় আরব ভূ-খণ্ডের কেউ তোমার পথের কণ্টক হতে পারবে না। তাইতো আবু তালিব মৃত্যু পর্যন্ত মহানবীর সাহায্য করে গেছেন। সুখে-দুঃখের সর্বাবস্থায় তিনি মহানবী (সঃ)-এর সাথে ছিলেন।
কুরাইশদের দূরভিসন্ধি ও বিপরীত ফল:
আবু তালিব রাসূল (সঃ)-এর ছায়া হয়ে গেলেন। কুরাইশদের দুশ্চিন্তা আরও প্রকট হল। এদিকে হজ মওসুম খনিয়ে আসছে। তাদের নিদ্রা হারাম হয়ে গেল। তারা ফন্দি আঁটল হজ মওসুমে কাউকে নবী করীম (সঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে দিবে না। কারণ নবী করীম (সঃ)-এর মায়াবী কথায় তারা নিজেরাই আটকে যায়। আর বাইরের লোক আসলেতো তারা তার বন্ধু হয়ে যাবে এবং তার ধর্ম গ্রহণ করে ফেলবে। তাই তারা মক্কার প্রবেশ দ্বারসমূহে লোক বসিয়ে দিল। তারা ঘোষণা করতে লাগল, আগন্তুক ব্যক্তিবর্গ সাবধান। মক্কায় রয়েছে এক যাদুকরের অবস্থান। তোমরা তার সাক্ষাৎ হতে বেঁচে থাক। সে পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেয়। আল্লাহর কুদরতে তাদের এই হীন ষড়যন্ত্র রাসূল (সঃ)-এর জন্য আশীর্বাদ হয়ে গেল। ফলে হজে আগন্তুকগণ ছাড়াও সে পথের পথিকদেরও ঐ লোকটিকে দেখার প্রবল আগ্রহ জন্মে গেল এবং দলে দলে মহানবী (সঃ)-এর দরবারে আগমন করল এবং হুজুর (সঃ)-এর আচার-ব্যবহারে অভিভূত হয়ে পড়ল। অনেকেই ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিল এবং মক্কা নগরীর বাইরেও ইসলামের বাণী প্রচার হতে লাগল।
রাসূল (সঃ)-কে হত্যার ব্যর্থ পরিকল্পনা:
ইসলামের ধারাবাহিক সফলতা দেখে আবু জাহল, ওৎবা, শায়বা অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ব্যথিত ও দুঃখিত হল। ইসলামের দৈনন্দিন অগ্রগতি তাদের হৃদয়ে ভয়ানক ক্ষতের সৃষ্টি করল। তারা নবী করীম (সঃ)-কে খতম করে দেয়ার হীন চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগল। একদা নবী করীম (সঃ) নামাজ আদায় করছিলেন। মানব জাতির রুশদ ও হিদায়াতের জন্য দরবারে ইলাহীতে ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন। আবূ জাহল এটাকে একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে করে, মস্ত বড় এক পাথর কাঁধে নিয়ে খুবই সতর্কাবস্থায় মহানবী (সঃ)-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আবু জাহল যখন নবী করীম (সঃ)-এর প্রায় কাছে চলে গেল তখন সে দেখতে পেল এক মস্তবড়উট মুখ খুলে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মনে হয় যেন তাকে বেছে ফেলবে। ঐ অবস্থা দেখে তার হৃদয় স্পন্দন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। পাদর ফেলে দিয়ে কোন ক্রমে হাঁপাতে স্বীয় পাপিষ্টসের সাথে মিলিত হল। তার সঙ্গী-সাথীরা তাকে তিরষ্কার করে বলতে লাগল, হে আবুল হেরাম। তুমি এ কেমন কাপরুষতা দেখালে। এমন সুবর্ণ সুযোগ তুমি হাত ছাড়া করসে। প্রতি উত্তরে আবু জাহল উটের ঘটনা বর্ণনা করল।
পাবলিশার অর্গানাইজেশন সিয়াম হাসান নিউজ লিমিটেড