(toc)
আবু তালিবের সাথে সিরিয়া যাত্রা:
দাদার মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিবের কাছে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বড় বড় হতে লাগলেন। চাচা স্বীয় ভাতিজাকে সযত্নে বড় করতে লাগলেন। হুজুর (সঃ)-এর বয়স যখন বার বছর দু'মাস দশদিন তখন চাচা আবু তালিব ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমনের মনস্থ করলেন। সাথে আপন ভাতিজাকেও নিয়ে নিলেন। 'তায়মা' নামক স্থানে তাদের যাত্রা বিরতি হল।
হুজুর (সঃ) এক বৃক্ষের নিচে নিদ্রা যাচ্ছিলেন। এক ইয়াহুদী আলেম-নাম তার বুহায়রা। সেখান দিয়েই অতিক্রম করছিল ঐ ব্যক্তি। মুহাম্মাদ (স)-কে দেখে সে থমকে দাঁড়াল। জিজ্ঞাসা করল, এ শিশুটি কারব। আবু তালিব এগিয়ে এলেন। বললেন, আমার ভ্রাতৃপুত্র। নাম তার মোহাম্মদ।
বুহায়রা বলল, তুমি একে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? তিনি বললেন-সিরিয়ায়। বুহায়রা বলল, তবে তুমি তাকে নিয়ে সিরিয়ায় গমন কর না। কেননা, তথাকার ইয়াহুদীগণ তাকে পেলে হত্যা করে ফেলবে। যেহেতু তিনি সর্বশেষ নবী হবেন। আমি তাওরাতে তার বিস্তারিত বিবরণ শুনেছি। এ কথা শুনে চাচা আবু তালিব অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হলেন এবং লোক মারফত হযরত (সঃ)-কে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন।
শিশু মোহাম্মদের চরিত্র:
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স) শৈশব হতেই ছিলেন সৎ বিনয়ী ও পরোপকারকারী একজন আদর্শ মানব। দুগ্ধ পান কালে তিনি হালিমার এক স্তনের দুধ পান করতেন। আর অপরটি দুধ ভাই আব্দুল্লাহর জন্য ছেড়ে দিতেন।
ছোট বেলাতে তিনি ছোট বাচ্চাদের খেলাধূলা দেখতেন। কিন্তু কখনও নিজে খেলায় অংশ গ্রহণ করতেন না। হায়া-লজ্জা এরূপ ছিল যে জীবনে কখন উলঙ্গ হননি। এমনকি কেউ তার বদন হতে কাপড়ও সরিয়ে নিতে পারেনি। একদা শৈশবে তিনি অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে কাবা ঘরের পাথর সরাচ্ছিলেন। পাথরের ওজনে তাঁর পবিত্র স্কন্ধে দাগ বসে যাচ্ছিল।
তাই তাঁর চাচা তাঁর লুংগি খুলে তাঁর কাঁধে দেয়ার মানসে কাপড় টান দিলে সাথে সাথেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাঁর চরিত্র মাধুরীতে সকলেই ছিল অভিভূত। তার প্রশংসা সকলেই মুখেই ছিল উচ্চারিত। তিনি ছিলেন ধনী গরীব সকলেরই আপনজন। ব্যক্তিগত কারণে তিনি কাউকে কখনো কিছু বলেননি। তাইতো সকলে মিলে তাকে শৈশব কালেই 'আল আমীন" উপাধীতে ভূষিত করেছিল।
সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফর:
আরবের এক ধনবতী মহিলা। সাম তার খাদীজা। তিনি ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। তার খ্যাতি ছিল সমগ্র আরব জুড়ে। নিশ্বস্ত ও আমানতদার লোকদের মাধ্যমে স্বীয় অর্থ সম্পদ দিয়ে ব্যবসা করান ছিল তার পেশা। বহু লোক তার মাধ্যমে সম্পদশালী হয়েছে। নবীয়ে করীম (স)-এর সততা, বিশ্বস্ততা দেখে বহুদিন থেকে তিনি তাঁর প্রতি ছিলেন খুবই দুর্বল। অবশেষে তিনি সাহস করে বলেই ফেললেন-যদি 'আপনি আমার ধন-রত্ন নিয়ে ব্যবসায়িক সফরে যেতে রাজি হন, তবে আমি অন্যদের তুলনায় আপনাকে অধিক লভ্যাংশ দিব।
আর আপনার খেদমতের জন্য আমার গোলাম মায়সারা তাকে আপনার সঙ্গী হিসেবে প্রদান করব। রাসুল (সঃ) এ সফরের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি সেড়ে নিলেন, এবং ১৬ই জিলহজ্ব সিরিয়া অভিমুখে ব্যবসার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে সিরিয়ায় মালামাল বিক্রি করে তথা হতে অন্য মাল ক্রয় করে নিয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন। হযরত খাদীজা (রাঃ) এগুলো বিক্রি করে দ্বিগুণ মুনাফা লাভ করলেন এবং তাঁর কৃত ওয়াদা মুতাবিক রাসূল (সঃ)-কে অধিক লভ্যাংশ প্রদান করলেন।
নাতুরা রাহেবের ভবিষ্যতদ্বাণী:
সিরিয়ার ব্যবসায়িক সফরের কোন একস্থানের সময় নান্ডুরা নামক জনৈক রাহেবের সাথে হযরত (সঃ)-এর সাক্ষাৎ ঘটে। ঐ রাহের হযরতের সেবক মায়সারার পরিচিত ছিল। তাই সে মায়সারাহকে জিজ্ঞাসিল, মায়াসারাহ। তোমার সঙ্গী এ ভদ্র লোক কে? মায়সারা জবাব দিল, ইনি মক্কার 'আল আমীন' সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের এক ইয়াতীম সন্তান। খাজা আবু তালিবের ভাতীজা। তখন মাতুরা বলল, ইনি অদূর ভবিষ্যতে নবী হিসেবে আবির্ভূত হবেন।
রাসূল (স)-এর পরিণয়:
ধনবতী খাদীজা এমনিতেই ছিল হুজুর (সঃ)-এর প্রতি অত্যাধিক দুর্বল। তদুপরী ব্যবসায় অভূতপূর্ণ সফলতা অর্জন করায় তিনি যেন হযরত (সঃ)-কে পাবার আশায় ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। তিনি একজন বিধবা বৃদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও পঁচিশ বছরের যুবক মুহাম্মদ (সঃ)-কে পাওয়ার আশায় উদগ্রীব হয়ে উঠলেন এবং কোন সংকোচ না করেই খাজা আবু তালিবকে এ প্রস্তাব পাঠান।
খাজা আবু তালেব তাৎক্ষণিক কিছু না বলে স্বীয় ভাতীজার সাথে সংগোপনে আলাপ সেরে বিবাহের সম্মতির কথা হযরত খাদীজা (রাঃ)-কে জানিয়ে দিলেন। আর এক সময় আবু তালিব, বনু হাশিম ও মুদারের সর্দারগণের উপস্থিতিতে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হলার বিয়ের খুৎবা আবূ তালিব নিজেই পাঠ করলেন। মোহরানার টাকাও স্বীয় সম্পদ হতে পরিশোধ করে দিলেন।
আশ্চর্য হলেও সত্য যে, নবী করীম (সঃ)-এর যৌবন কালটা এ বৃদ্ধা মহিলাকে দিয়ে কাটিয়ে দিলেন। এমনকি হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর জীবদ্দশায় হুজুর (সঃ) অন্য কার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি এবং হুজুর (স)-এর সকল সন্তান তার গর্তেই জন্য নেয়। তবে শুধু মাত্র তৃতীয় পুত্র ইবরাহীম বাদী মারিয়া কিবতীয়ার গর্তে জন্ম লাভ করেন।
হুযুর (সঃ)-এর সন্তানদের নাম :
হুজুর (সঃ)-র তিন জন পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। তাদের নাম হল-(১) হযরত কাসিম (২) হযরত তাহের (৩) হযরত ইবরাহীম, এবংচারজন কন্যা সন্তানের পিতা ছিলেন। তাদের নাম হল হযরত যয়নব (রাঃ)। হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ)। হযরত রুকাইয়া (রাঃ)। ও হযরত ফাতেমা (রাঃ)। হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর গর্তে দু'পুত্র দুইপুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে। তারা হলেন-হযরত ফাতেমা (রাঃ)-এর গর্ভে দু'পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে। তারা হলেন-হযরত হাসান (রাঃ) ও হুসাইন (রাঃ)।
হুজুর (সঃ)-এর বাকী স্ত্রীগণ:
হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর জীবদ্দশায় হুজুর (সঃ) অন্য স্ত্রী গ্রহণ করেননি। হযরত খাদীজা (রাঃ) মৃত্যুর পর তিনি আর দশ জন স্ত্রী গ্রহণ করেন। যার মধ্যে একমাত্র হযরত আয়শা সিদ্দীকাহ (রাঃ)-ই ছিলেন কুমারী, বাকী সকলেই ছিলেন বিধবা। যাদের অধিকাংশকেই হুজুর (সঃ) তাদের দুঃখ লাঘব করার জন্য স্বীয় পরিণয়ে আবদ্ধ করেছেন। যাদের পবিত্র নাম নিম্নে প্রদত্ত হল। (১) হযরত সাওদাহ্ বিনতে যামআহ্ (রাঃ) (২) হযরত আয়শাহ সিদ্দীকাহ্ (রা) (রা) হযরত হাফসাহ্ (রা) (৪) হযরত যয়নব বিনতে খোয়ায়মাহ (রাঃ) (৫) হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) (৬) হযরত যয়নব বিনতে জহশ (রা) (৭) হযরত জুয়ায় রিয়াহ্ (রা) (৮) হযরত উম্মে হাবীবাহ্ (রাঃ (৯) হযরত সাফিয়্যাহ (রা) (১০) হযরত মায়মুনাহ্ (রা)। হুজুর (সঃ)-এর পবিত্র রমণীগণের মধ্যে দু'জন অর্থাৎ হযরত খাদীজা (রাঃ) ও হযরত জয়নব বিনতে খোযায়মাহ্ (রাঃ) হুজুর (সঃ)-এর জীবদ্দশাতে ইন্তেকাল করেন। বাকী নয়জন নবী করীম (সঃ)-এর ওফাতের সময় জাবিত ছিলেন।
ন্যায় বিচারে মহানবী (সঃ):
মহানবী (সঃ)-এর বয়স যখন পঁয়ত্রিশ পূর্ণ হল তখন কুরাইশগণ বায়তুল্লাহ্ শরীফকে পুনঃনির্মাণের মনস্থ করল। যেহেতু এ কাজটি অত্যন্ত সৌভাগ্যের তাই প্রত্যেকেই এ কাজে অংশ গ্রহণে ইচ্ছুক ছিল। একথা চিন্তা করে কুরাইশগণ এ নির্মাণ কাজ সকল গোত্রের মাঝে বণ্টন করে দিল। নির্মাণ কাজ যখন হজরে আস্তয়াদ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল, তখন তাদের সম্মুখে নতুন সমস্যা দেখা দিল। প্রত্যেকেই হজরে আস্তয়াদ-কে স্থাপন করার মনস্থ করল। এমনকি এ ব্যাপারটি সংঘর্ষের রূপ ধারণ করল।
সকল গোত্রের নেতৃস্থানীয় লোকেরা এ ব্যাপারে মশৃওয়ারায় বসল। তারা চিন্তা করতে লাগল কি করে এ সংঘর্ষকে এড়ান যায়। সকলেই মসজিসে গিয়ে পরামর্শ করতে লাগল। বহু কথোপকথনের পর এ সিদ্ধান্ত হল যে, মসজিদের একটি দরজা নির্ধারণ করে বলা হল যে, যে ব্যক্তি এ দরজা দিয়ে সর্ব প্রথম প্রবেশ করবে তার সিদ্ধান্তই আমরা মেনে নিব। এ সিদ্ধান্তের পর সকলেই মসজিদে বসে আগন্তুকের অপেক্ষা করতে লাগল।
ঘটনাক্রমে হুজুর (সঃ)ই সর্ব প্রথম ঐ দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন এবং তাঁকে দেখামাত্র সকলেই সমস্বরে বলে উঠল, ইনিই তো আল আমীন আমরা তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে সকলেই প্রস্তুত।
নবী করীম (সঃ) তাদের সমস্ত ঘটনা শুনে বললেন, আপনারা একটি চাদর নিয়ে আসুন। চাদর আনা হল। হুজুর (সঃ) চাদরখানা বিছিয়ে হজরে আসওয়াদকে স্বহস্তে চাদরে রেখে বললেন, প্রত্যেক গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এ চাদরখানার চতুর্পাশ্ব ধরে খানায়ে কাবা'র কাছে নিয়ে চলুন। তারা সকলে তাই করল। তখন হুজুর (সঃ) স্বীয় হস্ত মুবারক দ্বারা পাথর খানা উঠিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন। ফলে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সুন্দর সমাধান হয়ে গেল।
প্রকাশক অর্গানাইজেশন সিয়াম হাসান নিউজ লিমিটেড