হুদায়বিয়া পরিচিতি:
হুদায়বিয়া একটি কূপের নাম। মককা মোয়াজ্জমার এক মঞ্জিল তথা ১৬ মাইল অদূরে এর অবস্থান। এ নামে একটি গ্রামও প্রসিদ্ধ রয়েছে। হুদায়বিয়াতে কোন যুদ্ধ হয়নি, বরং হয়েছিল মক্কার কুরাইশদের সাথে একটি সন্ধি। যেহেতু হুদায়বিয়া নামক স্থানে এটি সংঘটিত হয়েছিল তাই একে হুদায়বিয়ার সন্ধি বলা হয়ে থাকে।
ঘটনার সূত্রপাত:
মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনায় গমনের প্রায় ছ'টি বৎসর অতিক্রান্ত হতে চলল। সাহাবায়ে কেরাম ও রাসূল (রাঃ) দুনিয়ার প্রথম ঘর বায়তুল্লাহর জিয়ারত হতে বঞ্চিত। রাসুল (সঃ) উমরার নিয়তে ইহরাম বেঁধে মককা অভিমুখে রওনা হলেন। হুদায়বিয়ায় পৌঁছে মহানবী (স) হযরত উসমান (রাঃ)-কে মককায় প্রেরণ করলেন। কাফেররা তাঁকে গ্রেফতার করে ফেলল। এদিকে মুসলমানদের মাঝে রটে গেল। হযরত উসমান (রাঃ) শাহাদত বরণ করেছেন। তাই সকলেই রাসুল (সঃ)-এর হাতে জিহাদের বয়আত গ্রহণ করলেন। পবিত্র কুরআনে একে "বয়আতে রেজওয়ান" বলা হয়েছে। পরবর্তীতে জানা গেল।ঘটনা মিথ্যে, বরং কুরাইশগণ সন্ধির জন্য সুহায়ল বিন আমরকে সন্ধি করার জন্য প্রেরণ করছে। মহানবী (সঃ) নিম্নলিখিত শর্তগুলো মেনে নিয়ে দশ বৎসরের জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। চুক্তির শর্তসমূহঃ-
* মুসলমানগণকে এ বছর উমরা আদায় না করে ফেরত যেতে হবে। * আগামী বছর হজ্জে এসে মাত্র তিন দিন অবস্থান করে চলে যেতে হবে।
* কেউ অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আসতে পারবে না। যদি অস্ত্র থাকে তবে তা কোষ বন্ধ থাকবে।
* মককা থেকে কাউকে মুসলমান বানিয়ে মদীনায় নিয়ে যেতে পারবে। না। তবে কোন মুসলমান যদি মককায় থাকতে চায়। তবে বাধা দেয়া যাবে না।
* যদি কেউ মককা থেকে পালিয়ে মদীনায় চলে যায় তবে তাকে ফেরত দিতে হবে। আর যদি কেউ মদীনা হতে মককায় চলে আসে তবে তাকে ফেরত দেয়া হবে না।
এ সকল শর্তগুলো যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ছিল। তবুও আল্লাহ্ রাবলুল আলামীন এ সন্ধিকে 'ফাহুম মুবীন' বা প্রকাশ্য বিজয় বলে অভিহিত করেছেন।
হিজরী সাত:
এ বৎসর গযওয়ায়ে খায়বর সংঘটিত হয় এবং হুজুর (স) পাঁচ ৭টি সারিয়া (রা) (৩) সারিয়ারে গালিব বিন আব্দুল্লাহ (রা) (৪) সাবিয়ায়ে বশীর (রা) (৫) সারিয়ায়ে আহজাম (রা)
হিজরী আট:
এ বৎসর ইসলামের ইতিহাসের স্মরণীয় চারটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যার প্রত্যেকটিতে নবী করীম (সঃ) নিজে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন। (১) গযওয়ায়ে মৃতা। (২) মক্কা বিজয়। (৩) গযওয়ায়ে ইনায়ন (৪) গযওয়ারে তায়েফ এবং দশটি সারিয়া প্রেরণ করা হয়। (১) সারিয়ায়ে গালিব (রাঃ), বনী মগৃহ অভিমুখে (২) সারিয়ায়ে গালিব, ফিদাক অভিমুখে। (৩) সারিয়ায়ে সূজা (রাঃ) (৪) সারিয়ায়ে কাব (রাঃ) (৫) সারিয়াতে আর ইবনুল আস (রাঃ) (৬) সারিয়ায়ে আবু উবায়দাহ্ ইবনুল জররাহ্ (রাঃ) (৭) সারিয়ারে আবু কাতাদাহ (রাঃ) (৮) সারিয়ায়ে খালিদ (রাঃ) (১) সারিয়ায়ে তোফায়েল বিন আমর দৃসী (রাঃ) (১০) সারিয়ারে কাতাবাহ (রা)।
মক্কা বিজয়ের কারণ:
যষ্ঠ হিজরীতে সংঘটিত হয়ে যাওয়া চুক্তি পরিপূর্ণভাবে মুসলমানগণ পালন করতে লাগলেন। কিন্তু মাত্র দু'বছর না পেরুতেই কাফেররা সে চুক্তি ভঙ্গ করে বসল। নবী করীম (সঃ) দূত মারফৎ কয়েকটি নতুন শর্তারোপ করে তাদের কাছে এ ফরমান দিয়ে পাঠালেন।যদি এ শর্তগুলোকে চুক্তিতে অন্তরভুক্ত না করা হয় তবে ধরে নেয়া হবে আজ হতে দশ বছর মেয়াদের চুক্তির যবনিকা হল। কাফেররা চুক্তি ভাঙ্গনটাই পছন্দ করল।
সন্ধি চুক্তি ভাঙ্গার পর মহানবী (সঃ) ৮ম হিজরীর ৮ই রমাজানুল মুবারকে দশ হাজার সাহাবায়ে কেরামের এক বাহিনী নিয়ে মক্কা বিজয়ের অভিযানে বের হলেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে কোন রক্তপাত ছাড়াই মহানবী (সঃ) মককা বিজয় করলেন। আর চির শত্রু মক্কার কাফেরদেরকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় মাফ করে দিলেন।
পবিত্র বায়তুল্লাহ শরীফে তখনও ৩৬০ মূর্তির আস্তানা ছিল-হুজুর (সঃ) কাবা গৃহে প্রবেশ করে হাতের ছড়ি দিয়ে এক একটি মূর্তির দিকে ইশারা করার সাথে সাথেই উহা দুমড়ে-মুচড়ে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। প্রিয় নবী (সঃ)-এর পবিত্র জবান মুবারক হতে তখন পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি উচ্চারিত হচ্ছিল। সত্য সমাগত, মিথ্যা বিতারিত মিথ্যা তো বিতাড়িত হবারই।
নবম হিজরী:
এ বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গযওয়া সংঘটিত হয়। আর তা হলঃগযওয়ায়ে তাবুক। এছাড়াও তিনটি সারিয়া প্রেরণ করা হয়। (১) সারিয়ায়ে আল কামাহ্ (রাঃ) (২) সারিয়ায়ে আলী (রাঃ) (৩) সারিয়ায়ে উ্যাশা (রাঃ)।
হিজরী দশ:
এ বছর মাত্র দুটি সারিয়া প্রেরণ করা হয়। (১) সারিয়ায়ে খালিদ বিন ওযাযিল (রাঃ) (২) সারিয়ায়ে আলী (রাঃ) এবং এ বছরই হুজুর (সঃ) বিদায় হজ্জ আদায় করেন এবং আরাফাতের ময়দানে মানব জাতির চির কল্যাণের জন্য এক হেদায়াত ও উপদেশ পূর্ণ বক্তৃতা দেন। যার কিছু অংশ নিম্নে তুলে ধরা হল।
ওহে মানব জাতি। তোমরা আমার কথা শ্রবণ কর। আমি তোমাদের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বর্ণনা করছি। আমি জানিনা আগামী বছর তোমাদের সাথে মিলিত হতে পারি কিনা। তোমরা আজ যারা এখানে উপস্থিত আছ তারা, যারা উপস্থিত নেই তাদের কাছে যেন একথাগুলো পৌঁছে দেয়। ওহে আমার অনুচর বৃন্দ। অপরের জান-মাল ও সম্মান তোমাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত এমনভাবে হারাম করা হল-যেমনিভাবে এ দিন (আরাফার এ মাস জিলহজ্জ) ও এ শহর মকক্কার সম্মান রক্ষা করা হয়েছে। তাই কার কাছে যদি অন্য কারর আমানত থাকে তবে সে যেন তার আদায় করে।
হে, আমার প্রিয় সঙ্গী-সাথিগণ! তোমাদের উপর তোমাদের স্ত্রীদের কিছু হক রয়েছে এবং তাদের উপর ও তোমাদের হক রয়েছে। হে, লোক সকল! মুসলমান সব ভাই ভাই। কারর জন্য তার ভাইয়ের মাল তার সন্তুষ্টি ছাড়া বৈধ নয়। ওহে মুসলিম জাতি। আমার পর তোমরা পুনরায় তোমাদের পুরাতন ধর্মে ফিরে যেওনা। ফলে তোমরা নানা ধরনের কলহ-বিপদে লিপ্ত হবে। আর একে অন্যকে হত্যা করবে। এই জন্যই আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর কিতাব কুরআন কারীমে ও তার রাসূলের (সঃ) হাদীস রেখে যাচ্ছি। যতি তোমরা এ দুটি জিনিষকে ভালভাবে আঁকড়ে ধরতে পার তবে কখন পথ ভ্রষ্ট হবে না।
অতঃপর মহানবী (সঃ) বললেন। ওহে, লোক সকল! তোমাদের প্রভু বা পালনকর্তা এক অদ্বিতীয়। তোমাদের পিতা এক, তোমরা সকলেই হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তান। আর তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানী ঐ ব্যক্তি- যদি সবচেয়ে বেশী খোদাভীরু। কোন আরবের খোদা ভীরুতা ছাড়া অনারবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আর মনে রেখ আল্লাহ্র বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। হে, আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থাক। হজ্জ সমাপন করে দশদিন মক্কা মুয়াজ্জমায় অবস্থান করে মহানবী (সঃ) মদীনায় চলে আসেন।
একাদশ হিজরী:
সারিয়ায়ে উসামা বিন যায়দ (রাঃ) ও মৃত্যু ব্যাধি। এ হিজরীর ২৬শে সফর মহানবী (সঃ) হযরত উসামাহ্ বিন যায়দ (রা)-এর নেতৃত্বে একটি সারিয়া প্রেরণের প্রস্তুতি নেন। যা রাসূল (সঃ)-এর ওফাতের পর প্রেরণ করা হয়।
মৃত্যু ব্যাধি:
একাদশ হিজরীর ২৮শে সফর নবী করীম (সঃ) জ্বরাক্রান্ত হন। ক্রমেই এ জ্বর বাড়তে থাকে এবং একটানা তের দিন জ্বরাক্রান্তভাবে দুনিয়ার কষ্ট ভোগের পর অবশেষে ১২ই রবিউল আউয়াল রাহমাতুল আলামীন বিশ্ববাসীকে শোকের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে প্রিয় হাবীব আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন।
মহানবী (সঃ)-এর শেষ বাণী ও আজকের সমাজ:
আম্মাজান হযরত আয়শা সিদ্দীকাহ্ (রাঃ) বলেন, মৃত্যুর পূর্বে রাসূল (সঃ)-এর ঘাতক ব্যাধি এত বেশী বেড়ে গিয়েছিল যে হুজুর (সঃ) বসতেও সক্ষম ছিলেন না। কিন্তু ঐ কঠিন সময়ও নবী করীম (সঃ) চাদর হতে মাথা মুবারক বের করে দিয়ে দুটি কথাই বলতেন। ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের উপর এজন্য আল্লাহর আযাব এসেছিল যে, তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে সেজদার স্থান ও পুঁজার মণ্ডপ বানিয়ে ছিল। কাজেই আমার উম্মতগণ যেন তা থেকে বেঁচে থাকে।
দ্বিতীয় কথাটি ছিল-মহানবী (সঃ)-এর অবচেতন অবস্থায়ও বলে উঠতেন সালাত! সালাত! অর্থাৎ নামায। নামায! এর অর্থ হল আমার উম্মতগণ যেন নামাজকে ভালভাবে আঁকড়ে ধরে। কিছুতেই যেন নামাজ পরিত্যাগ না করে।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ। একটু ভেবে দেখুন তো! দয়ালু নবী যে দুটি বিষয় সম্পর্কে মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও আমাদের সতর্ক করে দিয়ে গেলেন, আমরা তাকে কতটা মূল্যায়ন করছি। আজকে আমরা নবী তো দূরের কথা একজন সাধারণ মানের ওলীর কবরকে আমরা পূজার মণ্ডপ বানিয়ে নিয়েছি। আর ঐ সকল মাজারে নানা ধরনের মান্নত করে থাকি। আর তাদের পদতলে নির্বিঘ্নে স্বীয় মস্তক লুটিয়ে দেই। অথচ এটা সম্পূর্ণ হারাম ও শিরকের অন্তর্ভূক্ত। আর আল্লাহ্ তায়ালা শিরক্ ব্যতীত সকল গোনাহকেই তওবার মাধ্যমে মাফ করে দিবেন। প্রিয় পাঠকবৃন্দ। অত্যন্ত আশ্চর্য হলেও সত্য যে, আমরা এহেন ঘৃণ্য অপকর্ম করছি। আর গোনাহের কাজে লিপ্ত হচ্ছি। কিন্তু এটাকে অন্যায় বা পাপ তো মনেই করছি না। বরং এটাকে পূণ্যের কাজ হিসেবে গ্রহণ করছি। আসুন আজ থেকে আমরা মাজার পূজা ও মাজারে মান্নত করা ছেড়ে দেই। আর কৃত অপরাধের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করি। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
নবী করীম (সঃ) নামাজের ব্যাপারেও আমাদেরকে সচেতন থাকতে বলেছেন। জীবনের কোন অবস্থাতেই নামাজ পরিত্যাগ করা যাবে না। ইসলাম নামাজের জন্য কত সুন্দর বিধান করে দিয়েছেন। যদি কেউ দাঁড়িয়ে পড়তে না পারে তবে বসে পড়বে। আর তাও না পারলে শুয়ে শুয়ে রুক সিজদাহ ইশারা দিয়ে আদায় করেও নামাজের কর্তব্য সম্পাদন করবে। এভাবে আদায় করতে না পারলে ইশারা দিয়ে নামায পড়বে। সর্বাবস্থায়ই নামাজ পড়তে হবে। নামাজের কোনই কনসেশন নেই। আর যদি কেউ এক ওয়াক্ত নামাজ ইচ্ছা করে কাজা করল তবে তাকে দু কোটি আটাশি লক্ষ বছর অগ্নির দাহ সহ্য করতে হবে। কিন্তু আফসোস! আজ আমরা নামাজকেও ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকে দ্বীন বুঝবার ও তদানুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আমিন!
পাবলিশের অর্গানাইজেশন সিয়াম হাসান নিউস লিমিটেড