(toc)
নর-নারী সমতা:
কুফু অর্থ সমান সমান। ইসলামী শরীয়াতে পাত্র পাত্রী উভয়ের অবস্থা সমান হতে হবে। উভয়ের অবস্থা সমান না হলে সেখানে বিবাহ দেয়া ঠিক নয়। দাম্পত্য জীবনকে সুখ শান্তিময় করা এবং পরকালে সুখী হওয়ার জন্য বর ও কনের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার বিধান করা হয়েছে। যাহাতে অশান্তি দূর হয়ে শান্তি কায়েম হয়। স্বামী স্ত্রীতে সামঞ্জস্য না থাকলে দাম্পত্য জীবন যাপনের পথে অনেক অসুবিধা দেখা দিতে পারে। এবং দাম্পত্য জীবনে মিল মহব্বত ব্যহতে হতে পারে। মেয়েকে বিবাহ দেওয়ার সময় ততটুকু লক্ষ্য রাখার প্রয়োজন পড়ে না ।
কারণ ছেলে স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারে কিন্তু মেয়েতো স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করা সম্ভব হয় না। ছেলে একটির পরিবর্তে চারটি বিয়ে করতে পারে কিন্তু মেয়ে তার স্বামীর কাছে থাকা অবস্থায় আর দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে না। পাত্র পাত্রী সমান হওয়ার অর্থ পাত্র এবং পাত্রী উভই মুসলমান হতে হবে। জ্ঞানী পাত্রের লজ্জাশীলা তাহার জন্য লম্পট, ভবঘুরে, মদখোর, বেনামাযী, ঘুসখোর, চোর, ডাকত খুনী হাইজ্যাকার পাত্র কোন দিনই সমান হবে না। পাত্র পাত্রীর আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন হতে হবে। যেমন পাত্র খুব গরীব কিন্তু পাত্রী বিরাট সম্পদশালী এমতাবস্থায় বিবাহ দেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু পাত্র যদি তেমন গরীব না হয়। পাত্রীর দেন মোহর ও আনুষঙ্গিক খরচপাতি চালাতে পারে, ভাত কাপড় ও ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে পারে তবে পাত্রী ধনী হলেও বিবাহ একজন উচ্চ শিক্ষিত ছেলের জন্য যদি অল্পশিক্ষিতা মেয়ের ব্যবস্থা করা হয় ইহাতে তাদের মনের মিল তেমন হয় না। তেমনি একজন বেশি শিক্ষিত মেয়ের জন্য কম দেওয়া যায়। শিক্ষিত ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করলে তাতেও তাদের মনের তেমন একটা মিল হবে না।
একজন সুন্দরী মেয়েকে একটি কালো কুৎসিত ছেলের সাথে বিয়ে দিলেও তাদের মনের মিল হবে না। তেমনি একজন কালো কুশ্রী মেয়েকে সুন্দর একজন ছেলের সাথে বিয়ে দিলে ও তাদের মনের মিল, প্রেম প্রীতি ভালবাসা অটুট হবে না। এতে পরিণামে সংসারে বিশৃংখলা দেখা দেয়ও পরে বিছিন্ন হয়ে যায়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় সম্পদের জোরে একজন কালো মেয়েকে সুন্দর ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হয় ফলে তাদের সংসারে প্রায়ই কলহ বেঁধে থাকে। স্বামী অন্য মেয়েলোকের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার চেষ্টা করে। নর-নরীর স্বাস্থের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন পাত্রী খুৰ স্বাস্থ্যবতী কিন্তু পাত্র একেবারে ক্ষীণ সেই অবস্থায়ও মানানসই হয় না। পেশাগত দিক দিয়েও সমতা রক্ষা করা উচিত। যেমন তাঁতীর মেয়ে কৃষকের ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। পাত্র পাত্রীর বসের দিকে চিন্তা করতে হয়। পাত্রের বয়স সব সময় কম থাকা উচিত। কিন্তু তাই বলে পাত্রের বয়স ৩৫/৪০ বৎসর আর মেয়ের বয়স ১৪/১৫ বৎসর এমন অবস্থায় বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। পাত্র-পাত্রীর বয়স ৫ বৎসর ব্যবধান থাকা ভাল। ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ছেলের সাথে আধুনিকা মেয়ের বিবাহ দেওয়া ঠিক নয়। তেমনি ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়ের সাথে আধুনিক শিক্ষিত ছেলের বিবাহ দেওয়া ঠিক নয়। সব দিক সমান দেখে ছেলে বা মেয়ের বিবাহ হলে তাদের সংসারে বেহেশতী সুখ নেমে আসে। আর এর বিপরীত হলে দোযখের দুঃখ নেমে আসে। সংসার এক বিভিষিকাময় স্থানে পরিণত হয়। কাজেই সমতা রক্ষা করে ছেলে মেয়ের বিয়ে দেওয়া একান্ত কর্তব্য।
বিবাহের আগে স্ত্রীর দেনমোহর ধার্য করতে হয়। দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্ত্রী হালাল হয় না। দেনমোহরই স্ত্রী হালাল হওয়ার শর্ত। দেন মোহর আদায় না করলে যদি স্ত্রী স্বামীকে স্পর্শ করতে না দেয় তবে স্বামী স্ত্রীকে স্পর্শ করতে পারবে না। তবে যদি স্ত্রী ইচ্ছা করে মোহরানার হক না নেয় তবে আলাদা কথা।
বিবাহের সময় সাধারণত স্বামী স্ত্রীকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকে। কোরআন পাকে বিভিন্ন যায়গায় মোহরানার কথা উল্লেখ আছে। বিনা মোহরানায় বিবাহ সম্পন্ন হয় না। বিবাহের সময় মোহরানার কথা উল্লেখ না করলে ও তাহা আদায় করা স্বামীর পক্ষে ওয়াজিব। স্বামী যদি বলে যে আমি বিবাহ করব কিন্তু মোহরানা দিব না। সে ক্ষেত্রে স্বামীর দাবী বাতিল হয়ে মোহরানা ওয়াজিব হয়ে যাবে।
দেনমোহর অতিরিক্ত ধার্য করা উচিত না। আর ধার্য করলে তা কমবেশি করা যাবে না। মোহর এই পরিমাণ হওয়া উচিত যাহা স্বামী সাধ্যানুযায়ী আদায় করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে মোহর ধার্য করে ঠিকই কিন্তু স্ত্রীর কাছ থেকে মাফ চয়ে নেয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ লক্ষ টাকা মোহর ধার্য করতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু ইহা ঠিক নয়। মোহরানা আদায় করার চিন্তা নিয়েই ধার্য করতে হবে এবং যতশীঘ্র সম্ভব তাহা আদায় করে দিতে হবে। অন্যান্য ঋণের মত মোহর একটা ঋণ। কাজেই ঋণ পরিশোধ করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যান্য ঋণের তুলনায় মোহরের ঋণ বেশি গুরুত্ব পূর্ণ।
মোহর কমপক্ষে দশ দেরহাম বা দুই টাকা দশ আনা পরিমাণ হতে হবে। ইহার কম হলে শুদ্ধ হবে না। বেশির কোন সীমরেখা নাই। তবে অনেক বেশি মোহর ধার্য করা উচিত নয়।
মোহরানার নির্ধারিত টাকা আদায় করতে হবে। অথবা নিজের ভাল ব্যবহার ও ভালবাসার দ্বারা স্ত্রীকে খুশী করে তাহার নিকট হতে ক্ষমা চেয়ে নিবে। যদি স্ত্রী মোহরানা ক্ষমা না করে তবে স্বামীর গোনাহগার হইতে হবে। রাগ করে বা ধমক দিয়ে বা কঠোর ব্যবহার করে ক্ষমা চাইলে তা ক্ষমা হবে না। স্ত্রী যদি সন্তুষ্ট চিত্তে ক্ষমা করে তবে ক্ষমা হবে। আল্লাহ পাক কোরআনে বলেছেন।
وَأتُوا النِّسَاءَ صَدُقَبِهِنَّ نَحْلَةً فَإِنْ طِبْنَ لَكُمْ عَنْ شَيْ مِنْهُنَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَرِيئًا
উচ্চারণ: ওয়া আতুননিসায়া ছুদু কীহিন্না নিহলাতান ফাইন বিনা লাকুম আনশাইয়্যিন মিনহু নাফসান ফাকুলুহু হানিয়াম মারিয়ান।
অনুবাদঃ তোমরা খুশীমনে স্ত্রীদের দেন মোহর আদায় করে দাও। হ্যাঁ তবে যদি স্ত্রী নিজের ইচ্ছায় ধার্যকৃত মোহর হতে কিছু অংশ তোমাকে দেয় তবে তোমরা আনন্দচিত্তে উহা খাও।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর নিজের বিবাহের একজন স্ত্রীর মোহর ছিল। আর তাহা তিনি ঘরের কিছু আসবাব পত্র দিয়ে পরিশোধ করেছিলেন। দশ দিরহাম।হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বিয়ের দেনমোহর ছিল পাঁচশত দিরহাম।হযরত উম্মে হাবিবা (রাঃ)-এর বিয়ের মোহর ছিল চারশত দিরহাম।হযরত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিবাহের দেনমোহর ছিল উপরে উল্লেখিত পরিমাণ।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কন্য। হযরত ফাতিমা (রাঃ)-এর বিয়ের মোহরানা ধাই করা হয়েছিল চারশত দিরহাম। যাহার পরিমাণ একশত ত্রিশ তোল। রূপার সমান। বর্তমান যুগে বেশি মোহরানা ধার্য করা এক ফ্যাশানে পরিণত হয়ে গেছে। বেশি মোহরানা ধার্য করলে, তাদের দৃষ্টিতে সামাজিক মর্যাদা বেশি হয়। কিন্তু দেখা যায় এই বেশি ধার্যকৃত মোহর কোনদিন পরিশোধ করা হয় না। ফলে মৃত্যুর পরে অনেক জায়গায় দেখা যায়, স্ত্রীর নিকট মোহরানার দাবী ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করে। আমার দেখা একটা ঘটনার কথা মনে আছে, একজন লোক তার মৃত্যু হল, কিন্তু সেই লোক মোহরানা সম্বন্ধে কোন ধারণাই রাখত না। সে ধারণা করতো মোহরানা বোধহয় বিয়ের একটা অংশ। যাহোক তার মৃত্যুর পরে তার স্ত্রীর নিকট গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, সে তার স্বামীর মোহরানার টাকা ক্ষমা করছে কি না। উত্তরে স্ত্রী বলল, আমি যে ক্ষমা করব আমাকে কি দিয়ে গেছে। তখন লোকজন বলতে লাগল, তোমাকে সবকিছু দিয়েই সে চলে গেছে। সবই তো রয়ে গেছে, সে কিছুই নিয়ে যায় নাই। কিন্তু স্ত্রীলোকটি তাতে রাজি না হওয়ায় একটা টিনের ঘর এবং একটা জমিন আলাদাভাবে দিয়ে তবে মোহরানার টাকা ক্ষমা করে নিল। এই ধরনের, পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। স্ত্রীর মোহরানার টাকা ক্ষমা না করলে আল্লাহ পাকও ক্ষমা করবেন না।
মোহরে মেছেল নির্ধারণ করা মোহরে মেছেল হল কন্যার কোন ফুফু, বোন, ভাতিজি এদের বিয়ের মোহর যেমন ছিল সেই অনুপাতে ধার্য করা। মোহরে মেছেল মায়ের মোহরের পরিমাণ হবে না। মাতা যদি একই বংশের হয়ে থাকে তবে মায়ের মোহরের মেছেল ধরা যাবে।
মোহরে মেছেল ধার্য করার নিয়ম হল, যার মোহর ধার্য করবে আর যার মোহরে মেছেলের পরিমাণ হবে তারা উভয়েই সমান হতে হবে। কন্যা যদি কম বয়সের হয় তবে মোহরে মেছেলের মেয়েলোক অল্প বয়সের হতে হবে। কন্যা যদি কুমারী হবে তবে তুল্য মহিলাও কুমারী হতে হবে। কন্যা বিবাহের সময় যেমন সম্পদের মালিক হয়ে তুল্য মহিলা ঐ ধরনের সম্পদের মালিক হবে। কন্যা দ্বীনদার পরহেজগার হলে তুল্য মহিলাও দ্বীনদার পরহেজগার হতে হবে। তবেই সেইক্ষেত্রে মোহরে মেছেল বিবেচিত হবে।
বিবাহের শর্তসমূহ বিবাহের রোকন দুইটি
১.ইযাব
২. কবুল।বিবাহের শর্ত দশটি। পাত্রপাত্রী জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হওয়া। একজন পুরুষ অন্যজন স্ত্রীলোক হওয়া।
৩. পাত্রপাত্রী উভয়ের সম্মতি থাকা
৪. পাত্র ও পাত্রী অথবা তাহাদের অলীকে ইযাব কবুল শুনতে পাওয়া।
৫. দুইজন পুরুষ সাক্ষী থাকা। অথবা একজন পুরুষ ও দুইজন স্ত্রীলোক সাক্ষী থাকা।
৬. সাক্ষীগণের নিজের কানে ইযাব কবুল শুনতে পাওয়া
৭. সাক্ষীগণ পাত্রপাত্রীর নিকটাত্মীয় হওয়া।
৮. পাত্র ও পাত্রী উভয়ে উভয়কে জানা
৯.ইসাঃ এ কবুল একই মজলিশে হওয়া।
১০. দেনমোহর ধার্য করা এবং উহা আদায় করা। আল্লাহ পাক কোরআনে বলেছেন, "তোমাদের পুরুষ হতে দুইজন সাক্ষী রাখ, যদি দুইজন পুরুষ না পাওয়া যায়, তবে একজন পুরুষ ও দুইজন স্ত্রীলোককে সাক্ষী রাখ।। সাক্ষীদের মধ্যে একজন পুরুষ না হলে স্ত্রীলোক যতই থাকুক কিন্তু শর্ত আদায় হবে না। সাক্ষীগণের জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে যদি পাত্রপাত্রী মুসলমান হয়, তবে সাক্ষীদের মুসলমান হতে হবে। সাক্ষীগণের সমনে ইযার কবুল হতে হবে। ইযাব কবুলের শব্দগুলো সাক্ষীগণের একত্রে শুনতে হবে।